‘মাওলানা মোস্তফা আজাদ আমার বাবাকে আব্বা ডাকতেন’

নায়েবে মোহতামিম, জামিয়া হুসাইনিয়া ইসলামিয়া আরজাবাদ, ঢাকা

মাওলানা মোস্তফা আজাদ রহ. ছিলেন আমার বাবা আল্লামা শামসুদ্দিন কাসেমী রহ. এর একান্ত শিষ্য। তিনিই তাকে আরজাবাদ মাদরাসায় নিয়োগ দেন এবং তার পরবর্তী প্রিন্সিপাল হিসেবে মনোনীত করেন।

আমার বাবা উপমহাদেশের বিখ্যাত তাফসির বিশারদ আল্লামা আহমদ আলী লাহোরী রহ. এর শিষ্য ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আরজাবাদ মাদরাসায় রমজান মাসে তাফসির কোর্স চালু করেন।

মাওলানা মোস্তফা আজাদ রহ. ১৯৭৬ কি ১৯৭৭ সালে আরজাবাদে আসেন তাফসিরের কোর্স করতে। রমজানের পর তাকে মাদরাসার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। তখন আমি দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র। সেই থেকে তার সঙ্গে আমার পরিচয়। তিনি আমার সরাসরি শিক্ষক।

আমি হুজুরের কাছে একাধিক কিতাব পড়েছি। প্রথম দিকে হুজুর কিছু বাংলা-ইংরেজিও পড়াতেন। তিনি সাধারণ শিক্ষায় বিএ পাশ ছিলেন। হুজুরের কাছে আমরা ইংরেজি, রওজাতুল আদব, দুরুসুল বালাগাত ও হেদায়া কিতাব পড়েছি।

তিনি অত্যন্ত চমৎকার পড়াতেন। সহজে বোঝানো ও সুন্দর উপস্থাপনের বিশেষ যোগ্যতা ছিলো। ভাষা ছিলো অত্যন্ত সাবলীল। হুজুরের চেহারায় ব্যক্তিত্বের প্রখর ছাপ ছিলো। তাই আমরা ছাত্রজীবনে অত্যন্ত ভয় পেতাম তাকে।

মাওলানা মোস্তফা আজাদ রহ. আরজাবাদ মাদরাসায় যোগদানের পর থেকে প্রশাসনিক কাজে নিয়োজিত ছিলেন। প্রথমে অফিস ইনচার্জ। পরবর্তীতে ভাইস-প্রিন্সিপাল ও প্রিন্সিপাল হন।

আমার মনে হয়, প্রশাসনিক কাজের এ ব্যস্ততা সত্ত্বেও হুজুর তার সামর্থ্যের সবটুকু ছাত্রদের দেয়ার চেষ্টা করতেন।

হুজুর ছাত্রদের সাহিত্য ও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি উৎসাহিত করতেন। বাংলা বক্তৃতা ও বিশুদ্ধ বাংলাচর্চার উপর গুরুত্ব দিতেন। তিনি ছাত্রদের সাহিত্যচর্চাসহ এক্সট্রা কারিকুলামের জন্য আল্লামা শামসুদ্দিন কাসেমি রহ. জমিয়তে তোলাবায়ে কওমিয়া বা ছাত্র সংসদ গঠন করেন।  মাওলানা মোস্তফা আজাদ দীর্ঘদিন তিনি ছাত্র সংসদের দায়িত্বশীল শিক্ষক ও সভাপতি ছিলেন।

মাওলানা মোস্তফা আজাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কেবল ছাত্র-শিক্ষক বা সহকর্মী নয়। আমাদের সম্পর্ক ছিলো ভাইয়ের মতো। তিনি আমার বাবাকে বাবা ডাকতেন। আব্বাও তাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। সে হিসেবে আমরা তার স্ত্রীকে ভাবি ডাকি।

আমার বাবার মৃত্যুর সময় কেবল আমারই লেখাপড়া শেষ হয়েছিলো। বাকিরা ছিলো ছোট ছোট। তিনি তার হাতে আমাদের সমর্পণ করে যান। যেনো তিনি আমাদের গড়ে তোলেন।

তিনি সারা জীবন আমাদের সেভাবেই দেখেছেন। তিনি যদি আমাদের পাশে না থাকতেন তবে আমরা হয়তো আজ এ পর্যন্ত আসতে পারতাম না। আমরা মনে করি, তিনি তার শিক্ষক ও গুরুর কথা রেখেছেন। তেমন আচরণই আমরা পেয়েছি।

১৯৯৬ সালে আব্বার মৃত্যু হয়। আব্বা আরজাবাদ মাদরাসার পরবর্তী মোহতামিম হিসেবে মাওলানা মোস্তফা আজাদের নাম বলে যান।  মজলিসে শুরা আব্বার ওসিয়ত রক্ষা করাই সমীচীন মনে করেছেন।

শুরার অন্যতম সদস্য মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ. শুরার বৈঠকে প্রস্তাব করেন মাওলানা মোস্তফা আজাদ রহ. যেনো আমাকে পরবর্তী সময়ের জন্য প্রস্তুত করেন।  মোস্তফা আজাদ রহ. তার কথা রেখেছেন। তার প্রস্তাবেই আমি মাদরাসায় নায়েবে মোহতামিম নির্বাচিত হই। বলা যায় তিনি আমাকে হাতে কলমে গড়েছেন।

মাদরাসার মিটিংগুলোতে তিনি আমাকে দিয়ে সিদ্ধান্ত লেখাতেন। অনুষ্ঠানগুলো পরিচালনা করতে দিতেন। মাদরাসার বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার আমার উপর অর্পণ করতেন।

শুধু প্রশাসনিকভাবে নয়। শিক্ষক হওয়ার পরও তিনি আমাকে আদর্শ শিক্ষক হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। আমার ভালো কাজে উৎসাহ দিয়েছেন। দৃষ্টিকটূ বিষয়ে সতর্ক করেছেন।

কর্মজীবনে ভালো করার জন্য নানান পরামর্শ দিয়েছেন। তবে কখনো বড় ভাইসূলভ আচরণ প্রকাশ পায় নি। সহকর্মী হিসেবে আমাকে যথাযথ মূল্যায়ন তিনি সব সময় করেছেন। আমার মনে হয়, তার প্রতি তার রাজনৈতিক ও আদর্শিক গুরু মাওলানা শামসুদ্দিন কাসেমী রহ. এর ঋণ তিনি কোনো দিন ভুলেন নি।

মাদরাসা পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত মনখোলা মানুষ ছিলেন। সব শিক্ষকই তাকে আপন ভাবতে পারতেন। যার কারণে আরজাবাদ মাদরাসায় শিক্ষকদের মধ্যে কোনো উপদলীয় কোন্দল নেই।

প্রশাসন পরিচালনা করতেন অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে এবং সবার সাথে মিশতেন সহজভাবে। মাদরাসার উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য নিজেকে উজার করে দিতেন। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আরজাবাদ মাদরাসার উন্নতি ও অগ্রগতি দেখলে যে কেউ তার অবদানের কথা স্বীকার করবেন।

রাজনৈতিক জীবনে তিনি ছিলেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ-এর নায়েবে সদর। রাজনৈতিক জীবনে তিনি ছিলেন নির্মোহ।

২০১৫ বা ২০১৬ সালের ৭ নভেম্বর জমিয়তের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের সময় তিনি নির্বাহী সভাপতি ছিলেন। কিন্তু দলের স্বার্থে শেষ জীবনে এসে এ পদ ছেড়ে দেন। নতুন প্রজন্মের যারা এখন রাজনীতি করছে তাদের জন্য এটা বিরাট এক শিক্ষা।

About the Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You may also like these